রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ১০:১০ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

কার ফাঁদে কে?

মোস্তফা কামাল:
ঘোষণা ছিল খেলা হওয়ার। ‘খেলা হবে-খেলা হবে’র জবাবে ‘খেলবেন, আসেন খেলি’-র মাঝে খেলা কিছুটা হয়েও গেছে। ওই খেলায় পুলিশ কনস্টেবল আমিরুলের লাশ পড়েছে। যুবদলের শামীমও নিহত, যদিও পুলিশের দাবি সে যুবদল কর্মী নয়। পরপারে সাংবাদিক রফিকও। লালমনিরহাটে শ্রমিক লীগের জাহাঙ্গীর ও রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বিএনপির রশিদও এ তালিকাভুক্ত। বাদ যাননি ডেমরায় বাসের হেলপার নাঈম। নিহতদের কেউ পুলিশ, কেউ কেউ বিএনপি-লীগ; কেউ বা হেলপার। মানুষ নয়? আর খেলার প্রাপ্তিটা কেবল নিহত ও স্বজনদের। আমিরুল-শামিম-রশিদ-জাহাঙ্গীরদের স্বজনদের নিয়তি। সামনে আরও কী খেলা অপেক্ষা করছে, কে পড়বেন লাশের বাকি তালিকায়- ভালো জানেন খেলোয়াড়-আম্পায়াররাই। তারা কামিয়াব, জয়ের ধারা ধাবমান। তাদের পরাজয় নেই। মৃত্যুর সঙ্গে সাফল্যও আছে পুলিশের। সরকারের নির্দেশে তারা চোখের পলকে সামান্য সময়ের মধ্যে হাজারো লোকের মহাসমাবেশ ম্যাজিকের মতো ফাঁকা করে দিতে পারে। পারে না বাজার সিন্ডিকেটের টিকিটি স্পর্শ করতে।

তলে তলে সমঝোতা বা বোঝাপড়ার আভাসে অন্তত রক্তারক্তি না হওয়ার একটা আশা জেগেছিল জনমনে। আবার নেতানেত্রীদের বডি ল্যাংগুয়েজ, খিস্তি-ভেংচি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, ছল-ছলনার মধ্যে শঙ্কাও ছিল। শেষতক শঙ্কাটাই বাস্তব হলো। ফিরে এলো ভয় জাগানিয়া হরতাল-অবরোধের মড়ক। আবারও রক্তের পুরনো খেলা, সহিংসতার জয়রথ। ২৮ অক্টোবরের কালো দিনে নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হতে তেমন সময় লাগেনি। স্টাইল অনেকটা হেফাজত দমনের মতো। ভ্যানু ভিন্ন। মতিঝিল টু পল্টন-কাকরাইল-ফকিরাপুল। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগের আর নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ। একটু দূরে আরামবাগে জামায়াতের জমায়েত। এর মধ্যেই সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসসহ নতুন করে সহিংসতার পুরনো অধ্যায়। সেদিন নয়াপল্টনে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি ছাড় দিলেও ছেড়ে দেয়নি।

এক সময় জামায়াতে ইসলামীর মুক্তাঞ্চল ছিল বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট। সেই এলাকাটিতে শান্তি সমাবেশ ডাকে আওয়ামী লীগ। আর জামায়াতে ইসলামীকে বরাদ্দ দেওয়া হয় আরামবাগে শাপলা চত্বরের কাছে মতিঝিলের একটি সড়ক। জামায়াত অনেক দিন ধরেই নিজেদের দৃশ্যমান করার সুযোগের খোঁজে ছিল। সরকারের সঙ্গে তাদের ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। সবুজ সংকেত পেয়ে তারা অনেকটা বীরত্বের সঙ্গে সমাবেশ করেছে। এর আগে, করেছে রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে। চরম দুর্দশার মধ্যেও তারা রাজনীতির মাঠে। কখনো কখনো আওয়ামী লীগ-জামায়াতকে টেক্কা দেয়। ফাঁদেও ফেলে। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠে বড় খেলোয়াড় আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। জাতীয় পার্টি তাল-লয় মেলায়। কিন্তু, গত ক’দিন কে কাকে ফাঁদে ফেলছে, কে কার ওপর ভর করছে তা অনেকটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। প্রশ্নবিদ্ধও। সরকারের বিরাগভাজন এবং সুনজরের সার্কাস শো চলছে সমানে। চিন্তা ও চরিত্রগতভাবে তাদের মধ্যে যথেষ্ট মিল। তারা কেউ অচেনা নয়। মানুষ তাদের ক্ষমতায় দেখেছে। বিরোধী দলেও দেখেছে। প্রত্যক্ষ করেছে রক্তপিপাসাও। এখানে জনগণের প্রাপ্তি-প্রত্যাশা একেবারে নগণ্য। খেয়ে না খেয়ে জনগণের একটু স্বস্তিতে বেঁচে থাকার মিনতির দুয়ারও বন্ধ প্রায়।

শ্রেণিচরিত্রে ব্যাপক মিলের মধ্যেও সরকার-আওয়ামী লীগ-বিএনপি-পুলিশ এখন পাল্টাপাল্টিতে লিপ্ত। লাশের দায় চাপানোর নানা কারিকুলামে তারা অভিজ্ঞ। বিএনপির কপালে আবারও আগুন-সন্ত্রাসীর তিলক মোটামুটি লেপ্টে দিতে সচেষ্ট সরকার। যদিও তারা কোমল-কুসুম, অহিংস আন্দোলনের দৃষ্টান্ত তৈরির চেষ্টা করেছে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেনি। কৌশলেও মার খেয়েছে। নাকি এর মধ্যেও কোনো সমীকরণ আছে বা নেপথ্য থেকে কেউ ভিন্ন রসায়ন ঢেলেছে? এ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। পুলিশের লাশ ফেলা, বিএনপি অফিসে আবার তালা লাগানো, দলটির নেতাদের ধরপাকড়, পুরনো মামলা তাজা করার মধ্যে রহস্য কম নয়। আয়োজনও ব্যাপক। এতে আসলে জিতল কে? খেলোয়াড়, রেফারি না আম্পায়ার। জনগণ কিন্তু দর্শকের গ্যালারিতেও নেই। তারা প্রাণে বাঁচতে পারলেই আপাতত সন্তুষ্ট। নির্বাচনের কাউন্ট ডাউন চলতে থাকলেও তাদের গরজ নেই সেদিকে। দ্রব্যমূল্যের উত্তাপে মানুষের সেদ্ধ অবস্থা। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনীতি যত সাংঘর্ষিক হবে, জনশৃঙ্খলা ও বাজার পরিস্থিতি আরও খেপাটে হবে। দুর্দশার পাগলা ঘণ্টা আরও কর্কশ হবে। হরতাল-অবরোধ সেখানে নতুন ধুন তুলবে। তা বিএনপির জন্যও কি শুভ হবে? না-কি আর হারানোর কিছু নেই ভেবে তারা আগ্রাসী হয়ে উঠবে? সরকারও কি সেরকমই চায়? সরকারের সেই চাওয়ার ফাঁদে বিএনপি পা দিয়েছে বলে ধারণা কারও কারও।

গণমাধ্যমের বিশেষ করে টেলিভিশন ফুটেজগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যায় ঘটনার সূত্রপাত কাকরাইল মসজিদের পূর্ব সড়কের সেন্ট মেরির ক্যাথিড্রালের সামনের গোল চক্করে। সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় গাজীপুর থেকে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে যোগদানের উদ্দেশ্যে আগত গাড়িবহর লাঠি প্রদর্শন করে। বিএনপি কর্মীরা এক পর্যায়ে তেড়ে গেলে গাড়ি ছেড়ে পুলিশের অবস্থানের পেছনে পালিয়ে যায় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পুলিশ চড়াও হয় বিএনপির সমাবেশের ওপর ব্যাপক বোমাবাজি, টিয়ার শেল আর রাবার বুলেট নিয়ে।

বিএনপির সমাবেশে সংঘর্ষের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগ টুইট বার্তায় সব পক্ষকে শান্ত থাকা ও সংযমের আহ্বান। এতে জানানো হয়, ভিসা নিষেধাজ্ঞার জন্য সমস্ত ঘটনা পর্যালোচনা করা হবে। এদিকে, ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়া বার্তায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু বলেছেন, পুলিশ সদস্য ও রাজনৈতিক কর্মী নিহত হওয়া, সাংবাদিক আর হাসপাতালে হামলার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সব সহিংসতার ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করবে। এর বাইরে তাৎক্ষণিক আরও কিছু খবর ঘুরছে নিউজ ফিডে। মহাসমাবেশকে ঘিরে সংঘর্ষের পর সন্ধ্যায় একজন নিজেকে মার্কিন প্রতিনিধি দাবি করে হঠাৎ নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে হাজির হন। পরে পুলিশ নিশ্চিত করে যে তিনি ভুয়া। এছাড়া, দিনের মধ্যভাগে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শ্যামা ওবায়েদসহ বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতা আমেরিকান ক্লাবে যাওয়ার খবরও আলোচিত। সেখানে তারা কিছুক্ষণ ছিলেন। তবে, কার কাছে গেছেন বা কী কথা হয়েছে তা এখনো জানার বাইরে।

২৮ অক্টোবরের দিন কয়েক আগে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান সৈয়দ আলতাফ হোসেনের গুলশানের বাসভবনে নৈশভোজ করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ অনেকে। আরও কয়েকটি দেশের কূটনীতিকসহ বিএনপি নেতা গয়েশ্বর রায়, বরকত উল্লাহ বুলু, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, তাবিথ আউয়াল, ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিন, ফজলুল হক মিলনের সঙ্গে ভোজে উপস্থিত ছিলেন একজন মন্ত্রীও। এ নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের ঘরানায় বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। সময় ও ঘটনার পরম্পরায় এসব বিষয় আলোচিত। রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ দূতাবাসের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের ঘনিষ্ঠতা, মার্কিন চিকিৎসক এনে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা, আবার হরতালে ফিরে যাওয়াসহ সাম্প্রতিক নানা ঘটনায় সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নতুন তাল-লয় লক্ষণীয়। অহিংস আন্দোলনের অঙ্গীকারের মধ্যে তাদের আবার হরতালে ফেরা রাজনীতির মোটাদাগের ঘটনা। গত মাস কয়েক ধরে নিয়মিত বলা হচ্ছিল- তারা ‘অহিংস’ কর্মসূচিতে আন্দোলনের সাফল্য আনবে। পেরেছেও কিছুটা। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নজরদারিতে তারা উৎসাহিত-পুলকিত। সেই সমীকরণে তাদের সংঘাতে পা বাড়ানোর কথা নয়। আবার সরকারও সে ধরনের কিছু করবে না বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু, ঘটনা ঘটল ধারণার বাইরে। টানা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় পড়া এ ছেদে বাহ্যত লাভবান সরকার ও সরকারি দল। তারা মোটা দাগে সফল।

কারা পুলিশ হত্যা করল? যুবদল নেতাকে কে হত্যা করেছে, কীভাবে তিনি মারা গেছেন? কারা সংঘর্ষ শুরু করেছে? ইন্ধন ছিল কার? আক্রমণকালে প্রধান বিচারপতির বাসার ফটকের পুলিশ কোথায় ছিল? তার বাসভবনের ভেতর আগেই কারও কি অনুপ্রবেশ ছিল? লাঠি আর বৈঠা বহনকারী যুবকদের নামিয়েছিল কারা? তাদের কোথাও আটকানোর চেষ্টা করেছে পুলিশ? বাসে আগুন কারা দিল? এক পক্ষ, না দুপক্ষই? কারা সেই পক্ষ? শাপলা চত্বরের মতো বিএনপির সমাবেশস্থলে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার আয়োজক কে? এসব প্রশ্নের হিল্লা হলে মিলতে পারে এ ধরনের আরও কিছুর জবাব। সেইক্ষেত্রে জিজ্ঞাসার নগদ জবাব মেলা কঠিন। এ ছাড়া সত্যের ভয় আছে দুদলসহ আরও অনেকের মধ্যেই। যা অনেকটা কবিগুরুর কবিতার মতো- ‘উজ্জ্বলে ভয় তার, ভয় মিটমিটেতে/ ঝালে তার যত ভয় তত ভয় মিঠেতে/ ভয় তার পশ্চিমে, ভয় তার পূর্বে,/ যেদিকে তাকায় ভয় সাথে সাথে ঘুরবে।/ ভয় তার আপনার বাড়িটার ইটেতে,/ ভয় তার অকারণে অপরের ভিটেতে/ ভয় তার বাহিরেতে, ভয় তার অন্তরে,/ ভয় তার ভূত-প্রেতে, ভয় তার মন্তরে।/ দিনের আলোতে ভয় সামনের দিঠেতে,/ রাতের আঁধারে ভয় আপনারি পিঠেতে।’

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

mostofa71@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION